ইংরেজ শাসনের যুগে নড়াইল জেলার বিভিন্ন গ্রামে নীল চাষের জন্য ইউরোপীয় (ইংরেজ) কোম্পানী নীলকুঠি নির্মাণ করে এবং নীল চাষ করে প্রচুর অর্থ আহরণ করে। ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে পর্যন্ত জেলার কয়েকটি প্রধান নীলকুঠির বর্ণনা এবং যেসব কুঠিতে নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল তা উল্লেখ করা হলো।
ইতনার কুঠি:
গ্রামটা লোহাগড়া থানার মধুমতি নদীর তীরে অবস্থিত। প্রখ্যাত ইউরোপীয় নীলকর সাহেব সি.এম.সি. মুনয়ার ১৮৪১ সালে ইতনায় কুঠি নির্মাণ করেন। বর্তমানে কুঠিটি মধুমতি নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। এখানকার কৃষকদের নীলচাষ করার জন্য নীলকর সাহেবরা চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। কয়েক বছর চাষীরা নীল চাষ করে দেখতে পায় তারা নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। চাষীরা নীল চাষ করা বন্ধ করে দিতে গেলে নীলকর সাহেবদের লাঠিয়াল বাহিনী কৃষকদের উপর নির্যাতন চালাতে শুরু করে। ইতনা ও তার আশপাশের কৃষকরা সংগঠিত হয়ে বিদ্রোহ শুরু করে। এক পর্যায়ে কৃষকরা ইতনার কুঠীর নীলকর সাহেব এডওয়ার্ড ম্যাককারসন কে হত্যা করে। তারপর থেকে ইতনায় নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়।
কলাবাড়ীয়া:
জেলার কালিয়া উপজেলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। প্রাচীনকালে এই গ্রামের নাম ছিল কেল্লাবাড়ীয়া। এই গ্রামের নীলকুঠি ছিল বেশ বড়। এই নীল কুঠির প্রধান ছিল এলেন ডানলপ নামে একজন ইংরেজ। মি. এলেন ডানলপ ছিল খুবই অত্যাচারী। কৃষকদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করতো। ১৮৫৯ সালে এই গ্রামের শেখ গোলাম আকবর ও মোহাম্মদ জকী মোল্যার নেতৃত্বে কৃষকরা বিদ্রোহ করে এবং নীলকর সাহেব এলেন ডানলপের লাঠিয়াল বাহিনীর (ঐ সময় তাদেরকে বরকন্দাজ বাহিনী বলা হতো) সাথে এক খন্ড যু্দ্ধ হয়। ঐ খন্ড যুদ্ধে ডানলপ সাহেবের বরকন্দাজ বাহিনী পরাজিত হয় এবং অনেক ইংরেজ সাহেবের দালাল নিহত হয়। মিঃ ডানলপ সাহেবকে কৃষকরা আটক করে এবং মিঃ ডানলপ প্রাণ ভিক্ষা চায়। কৃষক বিদ্রোহী নেতা গোলাম আকবর ও মোহাম্মদ জকি মোল্যার সাথে ডানলপ সাহেবের এক চুক্তি হয়। এই চুক্তির ফলে ডানলপের বিশাল ভূসম্পত্তি গোলাম আকবর ও জকি মোল্যাকে দিয়ে যায় এবং ডানলপ সেই মোতাবেক প্রাণে বেচে যায়। সেই থেকে এই গ্রামে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়।
উলোর কুঠি:
লোহাগড়া উপজেলার একটি ছোট গ্রাম। এই গ্রামের নীল কুঠির আসল অস্তিত্ব নেই। কুঠির একটি ধ্বংসাবশেষ গ্রামে রয়েছে। এই কুঠিতে নীলকর সাহেবের বরকন্দাজ বাহিনীর সাথে কৃষকদের বিদ্রোহ হয়েছিল।
রাধানগর নীলকুঠি:
লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামের পাশে অবস্থিত ছোট গ্রাম রাধানগর। ইংরেজ নীলকর এম. সি. মুনয়ার ১৮৪৩ সালে এই গ্রামে নীলকুঠি স্থাপন করেন। বর্তমানে এই নীলকুঠির অস্তিত্ব আছে। বিরাট পাকাবাড়ী ও পুকুর রয়েছে পরবর্তীতে জমিদার প্রথা চালু হলে জমিদাররা এই কুঠিটি তাদের খাজনা আদায় করার জন্য কাছারী হিসাবে ব্যবহার করতো। বর্তমানে জনৈক গ্রামবাসী বাসভবন হিসাবে ব্যবহার করছে।
আমডাঙ্গা:
জেলার লোহাগড়া থানার একটি বড় গ্রাম। মধুমতি নদীর ভাঙ্গনে গ্রামটি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। নদীর ভাঙ্গনের ফলে আজ আর আমডাঙ্গা গ্রামের নীলকুঠির কোন চিহ্ন নেই।
মল্লিকপুর নীলকুঠি:
মল্লিকপুর নীলকুঠির অস্তিত্ব হিসাবে শুধুমাত্র উঁচু একটি ভিটা রয়েছে। এলাকাবাসীর নিকট আজও নীলভিটা হিসাবে পরিচিত।
ঘোড়াখালী নীলকুঠি:
জেলার সদর উপজেলা চিত্রা ও নবগঙ্গা হতে দক্ষিণ দিকে খনন করা খালের সংযোগ স্থলে ঘোড়াখালী নীলকুঠি অবস্থিত ছিল। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস “কৃষ্ণকান্তের উইল” এ এই কুঠির বর্ননা পাওয়া যায়। এই কুঠিটি দ্বিতল ভবন ছিল। নীল চাষ লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় নড়াইলের জমিদাররা নীল চাষের জন্য এই ভবনটি ইংরেজ নীলকর সাহেবদের নিকট হতে ক্রয় করেন। নীল চাষ বিলুপ্ত হওয়ার পর এই বিশাল ভবনটি নড়াইল জমিদারের ম্যানেজারের বাসভবন হিসাবে দীর্ঘদিন ব্যবহারিত হয়েছিল। বর্তমানে কুঠির দালানের কোন চিহ্ন নেই। তবে নীলকর সাহেবদের কয়েকটি বাঁধান কবরের অস্তিত্ব ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
কালিয়া নীলকুঠি:
কালিয়া থানার নীলকুঠি সম্পর্কে যে ইতিহাস জানা যায় সেই ইতিহাসে দেখা যায় কলাবাড়িয়া বাঐসোনা ও নড়াগাতির নীলকুঠিই প্রধান হিসাবে গণ্য ছিল।
বাঐসোনা নীলকুঠি:
জেলার কালিয়া থানার বাঐসোনা নীলকুঠি ছিল বেশ বড়। বিরাট ও অনেক কক্ষবিশিষ্ট দালানে কুঠির কাজ পরিচালনা হতো। বর্তমান কুঠিটির অস্তিত্ব নেই। তবে কুঠির কয়েকটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া দালানের ইট ও নীলচাষ করে আনার পর নীল জাগ দেওয়ার জন্য যে পাকা চৌবাচ্চা ছিল সেই চৌবাচ্চার বাঁধানো চুল্লী ও ভাংগা লোহার কড়াই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কুমারগঞ্জ নীলকুঠি:
সদর থানার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নে নবগঙ্গা নদীর তীরে এই গ্রাম অবস্থিত। বর্তমানে এই গ্রামের কোন অস্তিত্ব নেই। অবাক হতে হয় স্থানটি এখন শংকরপুর মৌজায় অবস্থিত। নীলকুঠিটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এক সময় নড়াইল মহাকুমা সদরের স্থান নির্ধারণের সুপারিশ ছিল এই কুমারগঞ্জে। এটা এক ঐতিহাসিক স্থান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লোকেরা এই কুমারগঞ্জে একটি নীলকুঠি স্থাপন করে। এই নীলকুঠির প্রথম ম্যানেজার সে সময়ে এখানে ব্যক্তিগতভাবে জমাজমি ক্রয় করে সস্ত্রীক বসবাস করেন। কুঠির ম্যানেজার তার এক পুত্র জন ডি ব্যারেজ কে রেখে তিনি এই কুমারগঞ্জেই মারা যান। মিঃ জন ডি ব্যরেজ সাহেব এখানে বসবাস করতে থাকেন এবং তিনি এখানকার এক হিন্দু বাগদীর মেয়েকে বিয়ে করেন। এর মাঝে নীল চাষ উঠে গেলে তবুও জন ডি ব্যরেজ এখানে অবস্থান করেন। মিঃ ব্যরেজ বিখ্যাত শিকারী ছিলেন। বাঘ ও বুনো শুকর শিকারে তার খুব সুনাম ছিল। তার দুই পুত্র ছিল। ম্যালকম ডি ব্যরেজ এবং মাইকেল ডি ব্যরেজ। ম্যালকম একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার এবং নাট্যকর্মী ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। মাইকেল সাহেবের বংশধরগণ এখনও কুমারগঞ্জে (শংকরপুর মৌজায়) বাস করছে। তারা এখন এদেশীয় নাগরিক।
মহিষখোলা নীলকুঠি:
বর্তমান জেলা প্রশাসকের বাস ভবনের সাথে ছিল মহিষখোলা কুঠি। দীর্ঘদিন ঐ কুঠিটি ছিল মহকুমা প্রশাসকে বাসভবন। ১৯৮৭ সালে জেলা প্রশাসকের নতুন বাসভবন স্থাপনের পর এটা বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তা ভেঙ্গে ফেলা হয়। কুঠিটি সংস্কার করে রাখলে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে আজও থাকত। বর্তমানে কুঠিটির কোন অস্তিত্ব নেই।
নড়াগাতী নীলকুঠি:
এককালে নড়াগাতী ছিল নদীবন্দর। এখানে একটি বড় ধরণের নীলকুঠি স্থাপন করা হয়েছিল। মিঃ লুইজ নামে এক ইংরেজ সাহেব এ কুঠির প্রধান ছিল। কালিয়া উপজেলার রামপুরা গ্রামের চৌধুরীদের সাথে কুঠির প্রধান লুইজ সাহেবের বিরোধ দেখা যায় এবং এক পর্যায়ে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের পর মিঃ লুইজ পালিয়ে যান এবং সেখান থেকে নড়াগাতী নীলকুঠি বন্ধ হয়ে যায়।
নীল চাষে এদেশীয় শ্রমিক জনসাধারণ সহযোগিতা না করার ফলে নীলকর সাহেবগণ বিহার প্রদেশ (বর্তমান ভারত) থেকে সাওতাল সম্প্রদায়ের লোকদের নীল প্রক্রিয়াজাত শ্রমিক হিসাবে আমদানী করে। এদের দেহের গঠন যে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের তা হল গায়ের রং কৃষ্ণ বর্ণ, মাঝারী ধরণের লম্বা বৈশিষ্ট্য, ঠোট কিছুটা মোটা। এদের ভাষার ধরণ শব্দ প্রয়োগ এবং উচ্চারনের ভঙ্গী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকদের মত।
আমাদের এ জেলায় তারা বুনো সম্প্রদায় বা সর্দার নামে পরিচিত। জেলার সদর থানা, লোহাগড়া ও কালিয়া থানার কয়েকটি গ্রামে আজও বসবাস করছে। বিশ্বে কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হওয়ায় এবং নীল চাষে নীলকরদের অত্যাচারে এদেশের চাষীরা নীল চাষ করাতে অনিচ্ছুক হওয়াতে নীলকর সাহেবগণ ব্যবসা বানিজ্য ছেড়ে চলে যায়। কোন কোন নীলকর সাহেব অন্য ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে। এদেশীয় অনেক জমিদার অনেক নীল কুঠি কিনে নেয়, সেগুলি জমিদারদের খাজনা আদায়ের কাছারী হিসাবে ব্যবহারিত হতে থাকে। আমাদের নড়াইল জেলার কিছু জমিদার নীল চাষ চালাতে থাকে। ইংরেজ নীলকর সাহেবদের চেয়ে বেশী করে অত্যাচার চালাত নড়াইলের জমিদার। জমিদারের বিভিন্ন গ্রামে কিছূ দালাল ছিল। যদি কোন কৃষক নীল চাষ সম্পর্কে কোন খারাপ মন্তব্য করতো আর সে খবর জমিদারের কানে পৌঁছাবার সাথে সাথে জমিদার তার লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে সেই কৃষককে ধরে এনে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করতো। এছাড়া নড়াইলের জমিদার ছিল সাম্প্রদায়িক মনের।
এখন নীল চাষ নেই, নীল কুঠিও প্রায় বিলুপ্তর পথে। কিন্তু ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচার ও সেদিনের কৃষকদের সাথে বিভিন্ন নীল কুঠিতে সংঘর্ষের সময় নিহত কৃষকদের রক্তে লেখা ইতিহাস আজও মানুষের মনের মনিকোঠায় গেঁথে রয়েছে। নীলকরদের আনীত শ্রমিক (বুনো সম্প্রদায়) লোকেরা এখনও এদেশের মানুষ হয়ে বেঁচে আছে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।